সুস্থতায় যোগ হোক নতুন মাত্রাঃ মাচা চা

মাচা – শব্দটি শুনলেই বাঙালির মনে প্রথম যে দৃশ্যপট ভেসে ওঠে তা হয়তো লাউয়ের মাচা! কিন্তু এই মাচা (Matcha) আদতে একধরনের চা এর নাম। চা গাছ তথা Camellia Sinensis এর পাতা থেকে বিশেষ উপায়ে তৈরি এই চা জাপানে বিশেষ প্রসিদ্ধ। চা পাতা থেকে প্রস্তুত করা হলেও এর প্রক্রিয়াজাত প্রণালী, স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ সবই আমাদের দেশীয় চা অপেক্ষা বেশ ভিন্ন প্রকৃতির। 

ইতিহাসের পাতা থেকে মাচা (Matcha) সমাচার

বর্তমানে মাচার জন্য জাপান সমৃদ্ধ হলেও এর প্রথম প্রাপ্তিস্থল ছিলো চীন। ১২শ শতাব্দীতে জাপানের অধিবাসীরা মাচা চা এর সাথে পরিচিত হয়। চীনে দীক্ষা গ্রহণকারী এক সন্যাসী জাপানে ফেরত যাওয়ার সময় সাথে করে চায়ের বীজ নিয়ে যান এবং উপাসনার একটি অংশ হিসেবে এই চা প্রস্তুতি শুরু হয়।

বিশেষ করে জেন মন্দিরগুলোতে ধ্যান অনুশীলনের সময় মনোযোগ বৃদ্ধি এবং সজাগতা বজায় রাখার জন্য এটি ব্যবহৃত হত। এভাবেই আস্তে আস্তে জাপানে মাচা চা প্রচলিত হয় যা উনিশ শতাব্দীতে পশ্চিমাদের সাথে বানিজ্যিক সম্প্রসারণের সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে। 

মাচার পরিচিতি 

মাচা মুলত এক ধরনের গ্রিন টি। তবে এই চা প্রস্তুতির জন্য ধাপগুলো বেশ কঠোর ভাবে মেনে চলা হয়। মাচা চা প্রক্রিয়াজাত করার জন্য বেছে নেওয়া হয় ছায়ায় থাকা চা গাছগুলোকে। সেসব গাছের পাতায় থাকে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় ক্লোরোফিল। ছায়ায় থাকা চা গাছের কুড়ি এবং প্রথম তিন ধাপের পাতা সংগ্রহ করা হয় এই চা প্রস্তুতির জন্য। এই পাতাগুলো প্রথমে বাষ্পায়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় যেনো এদের অক্সিডেশন বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর পাথরের যাঁতার মধ্য দিয়ে পিষে গুঁড়ো করে তৈরি করা হয় সবুজ রঙের এই চা। এই চা প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতির জন্য বিশ্বের অন্যতম দামী চা হিসেবেও এর কদর রয়েছে। তবে প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় কিছু ধাপ সহজ হয়ে উঠলেও চা প্রস্তুতকারকেরা এর স্বাদ ও মানের ব্যাপারে এখনও বিশেষ যত্নশীল। কেননা এর প্রস্তুতির মাঝেই অনেকাংশে লুকিয়ে আছে এর উপকারিতা। 

মাচার পুষ্টিগুণ

USDA (U.S Department of Agriculture) এর তথ্য অনুযায়ী প্রতি ১০০ গ্রাম মাচা চায়ে রয়েছে – 

৩৭৫ কিলোক্যালরি শক্তি, ২৫ গ্রাম প্রোটিন, ৭৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ২৫ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার বা খাদ্য আঁশ, ২৫০ মি.গ্রা ক্যালসিয়াম এবং ১২৫০ মি.গ্রা পটাসিয়াম।

চমৎকার ব্যাপার হচ্ছে এতে ফ্যাট, কোলেস্টেরল, চিনি এবং সোডিয়াম রয়েছে শূন্যের ঘরে; অর্থাৎ এই উপাদানগুলো অনুপস্থিত। আর এগুলো কোন না কোন ভাবে আমাদের দেহের ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম। এতোসব গুণাগুণের জন্যেই তো এই চা কে সুপারফুড হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

মাচা (Matcha) যখন উপকারী

শুধু যে এর প্রক্রিয়াকরণ প্রণালীর জন্য এই চা এর এতো পরিচিতি তা কিন্তু নয়। বরং বিভিন্ন গুণাবলীর জন্য আজ মাচা চা বিশ্ব দরবারে চাহিদার শীর্ষে রয়েছে। এতে রয়েছে ক্যাফেইন এবং বেশ ভালো পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এছাড়াও এতে কিছু পরিমাণ অ্যামাইনো অ্যাসিড পাওয়া যায়। মাচা চা ঠিক কীভাবে আমাদের শরীরের জন্য উপকারী ভূমিকা রাখে এবার সেটা দেখে নেওয়া যাক – 

১। হৃদসুরক্ষায় মাচা

মাচার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি গুণাগুণ আর এতে বিদ্যমান এল-থিয়ানিন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মূলত হৃদসুরক্ষায় ভূমিকা রাখে। হৃদযন্ত্রের নানা রোগের পিছে মূখ্য কারণ হিসেবে ভূমিকা রাখে প্রদাহ।

আর মাচার অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি গুণাগুণ এই প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াই করে হৃদযন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখে। এছাড়া অ্যাথেরোসক্লেরোসিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং অন্যান্য হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করতেও সাহায্য করে এই সবুজ চা। 

২। মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে

মাচাতে আছে ক্যাফেইন এবং এল-থিয়ানিন (L-theanine) নামক একটি অ্যামিনো অ্যাসিড। ক্যাফেইন মস্তিষ্ককে সজাগ রাখতে এবং মনোযোগ ধরে রাখতে কাজ করে। অপরদিকে এল-থিয়ানিন অ্যাংজাইটি ও চাপ কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

এছাড়া এতে উপস্থিত এপিগ্যালোক্যাটেচিন গ্যালেট (epigallocatechin gallate) সংক্ষেপে EGCG নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট নিউরো-প্রোটেক্টিভ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া এই চা মস্তিষ্ককে আরও কর্মক্ষম করে তোলে এবং চিন্তাশক্তিকে সৃষ্টিশীল করে তোলে। 

৩। ওজন নিয়ন্ত্রনে

ওজন নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে এই চমৎকার চা টি। এই চা কম ক্যালরি যুক্ত একটি পানীয় যা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তাছাড়া এটি মেটাবলিজম প্রক্রিয়াকে ত্বরাণ্বিত করে দেহের ফ্যাট সেলকে ভাঙতে সহায়তা করে। ফলে ওজন থাকে নিয়ন্ত্রণে।

৪। লিভারের জন্য ভালো

মাচা চা লিভারকে ডিটক্সিফাই করতে সাহায্য করে। একই সাথে এটি লিভারের কোষগুলোকে ক্ষতগ্রস্থ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। 

৫। ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে

মাচাতে আছে এপিগ্যালোক্যাটেচিন গ্যালেট (epigallocatechin gallate) সংক্ষেপে EGCG নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যার বেশ শক্তিশালী অ্যান্টিক্যান্সার গুণাগুণ বিদ্যমান। একই সাথে এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টটি টিউমারের বৃদ্ধিকে রোধ করে এবং ক্যান্সার কোষের ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করে।

এছাড়াও এতে উচ্চ মাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় এটি দেহের প্রদাহের বিরুদ্ধে কাজ করে যা আদতে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দান করতে ভূমিকা রাখে। 

৬। দাঁতের সুরক্ষায় কাজ করে

এতে বিদ্যমান পলিফেনল মুখ গহ্ববরের ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংস করে এবং দাঁতের ক্ষয় রোধ করে। একই সাথে মুখের দূর্গন্ধ দূর করতেও সহায়তা করে। 

৭। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়

এই চায়ে রয়েছে বেশ ভালো পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা দেহের মুক্ত মূলক বা ফ্রি র‍্যাডিকেল এর মাত্রা কমানোর মাধ্যমে কোষের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায় এবং কোষের ক্ষয় রোধ করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে বেশ ভালো ভূমিকা রাখে। 

৮। ব্রণের সমস্যা দূর করতে

ব্রণ একটি সাধারণ সমস্যা, বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে। তবে এই ব্রণ বা ব্রণের দাগ দূর করতে অনেকেই হিমশিম খান। মাচা চা এই সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে বেশ ভালো ভূমিকা রাখতে সক্ষম। কেননা এতে রয়েছে বেশ ভালো পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ব্রণের বিপরীতে কাজ করে।

একই সাথে এর রয়েছে অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি গুণাগুণ যা ব্রণের লালচে ভাব দূর করে সংক্রমন এড়াতে ভূমিকা রাখে। তাছাড়া কিছু ক্ষেত্রে এই চা হরমোনের তারতম্যকে ঠিক রাখতেও ভূমিকা রাখে। ফলে নিয়মিত মাচা চা সেবন ব্রণের বিপরীতে কাজ করে। 

৯। ত্বকের সুরক্ষায়

এই চায়ে বিদ্যমান অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের ক্ষতি সাধনকারী মুক্ত মুলক বা ফ্রি র‍্যাডিকেলের বিরুদ্ধে লড়াই করে। একই সাথে এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের জেল্লা ধরে রাখে এবং বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করে। পাশাপাশি এতে বিদ্যমান ক্লোরোফিল ত্বককে ডিটক্সিফাই করে এবং সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাব হতে ত্বককে রক্ষা করে।

বর্তমান বিশ্বে মাচা যেনো এক যাদুর নাম। বিশেষ করে যারা নিয়মিত চা পান করেন আবার শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ থাকতে চান তাদের জন্য এই চা যেনো আশীর্বাদ স্বরূপ।

এতে উপস্থিত উপাদানগুলো একই সাথে আমাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতায় ভূমিকা রাখে এবং আমাদের করে তোলে চাঙ্গা ও কর্মোদ্দীপ্ত। তাইতো প্রতিদিনের অভ্যাসে এই চা যোগ করে সুস্থতায় এক অনন্য মাত্রা। 

কিন্তু বাংলাদেশে বসে অথেনটিক মাচা কোথায় পাবেন?

আমাদের দেশে কিছু অভিজাত স্টোরে মাচা চা পাওয়া যায়, তবে সেগুলো চীনে উৎপাদিত হওয়ায় স্বাদ, গন্ধ ও গুণগত মানের দিক দিয়ে অথেনটিক জাপানিজ মাচা চায়ের চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে। তবে খুশির সংবাদ যে, অথেনটিক জাপানিজ মাচা চায়ের বিভিন্ন ফ্লেভারের দারুণ সংগ্রহ পেয়ে যাবেন Matchaao.com এ।

USDA Organic, EU Organic সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন প্রাপ্ত মাচা চায়ের স্বাদ নিতে অর্ডার করে নিতে পারবেন ঘরে বসেই। এছাড়াও দারুণ সব মজার রেসিপিও পেয়ে যাবেন matchaao ওয়েবসাইটে। 

Similar Posts